দলিলসুত্রতারিখশিরোনামপৃষ্ঠা
৮৬সচিত্র স্বদেশ বিজয় দিবস সংখ্যা১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২শহীদ চার ভাই৫১৯-৫২০

শহীদ চার ভাই

“মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চার ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্যাপটেন মোজাম্মেল হোসেন বললেন, “১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী পরিণত হলো ঘাতক বাহিনীতে। ওরা পশুশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র জনগণের উপর। আমাদের তখন বাসা ছিল মগবাজারের মধুবাগে। রাজারবাগের পুলিশ বাহিনীর উপর খান সেনাদের আক্রমণ শুরু হলো। আমরা ক’ভাই আমাদের এম.এল, রাইফেল, দোনলা বন্দুক এবং হাতে বানানো গ্রেনেড নিয়ে এগুলাম। পজিশন নিলাম মালিবাগ মোড়ে। প্রথম কাউন্টার হতেই দেখলাম দ্রুত বেগে ট্রুপ ছুটে আসছে রাজারবাগ থেকে। পিছু হটে আসা পুলিশ সদস্যদের ফেলে যাওয়া কয়েকটা রাইফেল নিয়ে আমরা মগবাজারে ফিরে এলাম।

পরবর্তী দিনগুলো কাটলো অবর্ণনীয় ভীতির মধ্য দিয়ে। ঢাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে আসছে। সবাই পালাচ্ছে। এমন এক সময়ে রেডিওতে মেজর জিয়ার ভাষণ শুনে ভরসা পেলাম। এদিকে পাবনা (আমাদের দেশের বাড়ি) থেকে খবর এলো, পাবনা তখনও মুক্ত। ২৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি পাবনা অপারেশনে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে আমার দুই ভাই এমনকি বৃদ্ধ বাবাও যোগ দিয়েছেন প্রতিরোধ যুদ্ধে।

ঢাকায়ও প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছে। মে মাসের প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বিস্ফোরণ এবং গুলি বিনিময় চলছে এখানে, ওখানে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ২ নং সেক্টর থেকে ঢাকায় এসে গেছে। এর মধ্যে জয়নাল গ্রুপের সঙ্গে বাড্ডায় গিয়ে দেখা হয়। এক বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান পেলাম। ওদের কিছু অস্ত্র আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হলো। এবং তখন থেকেই সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু হলো। আমরা বেশ কয়েকটা অপারেশন চালিয়েছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রামপুরা পাওয়ার স্টেশন এবং খিলগাঁও জেনারেটরে গ্রেনেড নিক্ষেপ, প্রভৃতি। ইতিমধ্যে নিউমার্কেট, দিলকুশা ও জিপিওর সামনে বেশ বেশ কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটে। আশ্বস্ত হলাম যে, যাক আমরা শুধু একা নই। অন্যত্রও চলছে প্রতিরোধের তৎপরতা। এদিকে আমাদের কথা ততদিনে জানাজানি হয়ে গেছে। খবর পেলাম যে কোনো দিন বাসায় রেইড হতে পারে। ঐ রাতেই আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের অন্যত্র রেখে এসে কুমিল্লা হয়ে সীমান্ত পেরোবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। খবর পেলাম পাবনার বাড়িও লুট হয়ে গেছে। আবার ঢাকা হয়ে আরিচা-নগরবাড়ির পথ ধরে পাবনা হয়ে সীমান্ত পেরোবার সিদ্ধান্ত নিলাম। নগরবাড়ি ঘাটে নামার সাথে সাথে খান সেনাদের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় ক্যাম্পে। সেখানে কয়েকটা দিন কাটলো প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায়। ক্যাম্পের অনেককেই পালাক্রমে ফায়ারিং স্কোয়াডে তোলা হলো।

চতুর্থ দিন আমাদের বধ্যভূমির দিকে নিতে এসেছে। আমাদের তোলা হলো একটা ট্রাকে। এ সময় আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। মরতে যখন হবেই তখন শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। সমস্ত শক্তি আর সাহস নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে revolt করে বসলাম। সিগারেট ধরাবার নাম করে এক সেন্ট্রির থুতনিতে মারলাম ঘুষি। চারদিনের ক্ষুৎপিপাসা ও মৃত্যুর ভয়ে জর্জরিত দেহে জানি না অতো শক্তি সেদিন কোত্থেকে পেলাম। ততক্ষণে আমার অন্যান্য সহযাত্রীরা অন্যান্য সেন্ট্রি ও চালককে ঘায়েল করে ফেলেছে। হাইওয়ে ফেলে গ্রামের রাস্তা ধরে আমরা প্রাণ নিয়ে পালালাম।

ওপারে গিয়ে দেখলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক চিত্র। দেখা করলাম যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে। তাঁকে আগে থেকে চিনতাম। গ্রুপ ক্যাপটেন এ.কে.খন্দকারের সাথে দেখা করে অকপটে জানালাম, “এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একা সৈনিক। আমি যুদ্ধ করতে এসেছি, আরাম করতে আসিনি। আমাকে যুদ্ধে পাঠান।“ আমার ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারলেন এবং ৭নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে কাজ করার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো আমার কেটেছে ঐ ৭নং সেক্টরেই।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রতিদিন চলছে সংঘর্ষ। প্রতিদিনই কিছু না কিছু এলাকা মুক্ত হচ্ছে। এরকম সময়ে (অক্টোবরের ২০ কি ২২ তারিখ) ছোট ভাই মোস্তাকের চিঠি পেলাম-ওরা গ্রুপ নিয়ে দেরাদুনে ট্রেনিঙে যাচ্ছে। শিয়ালদা রেল স্টেশনে ওর সাথে দেখা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিধ্বস্ত শরীর। ওই ওর সাথে শেষ দেখা।

আর এক ভাই (রঞ্জু) তখন লড়াই করছে ২নং সেক্টরে। মঞ্জু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (পরে সে সাধারণ ক্ষমার সুযোগে মুক্তি পায়)। মুকুল লড়াই করছে পাবনার রণাঙ্গনে। একদিন যুদ্ধ শেষ হলো। থেমে গেলো রণদামামা। সব পথ তখন এসে মিলেছে ঢাকায়। ঢাকার পতন তখন দিনকয়েকের ব্যবধানে। আমি কিন্তু ৭নং সেক্টরের দায়িত্ব তখনও শেষ করতে পারিনি। দেশে ফেরার পথে পাবনায় ভাইদের মর্মান্তিক মৃত্যুর কোথা শুনলাম। দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হবার দিন কয়েক আগে রঞ্জুকে শেষ দেখা গেছে ঢাকার রূপগঞ্জে।

এদিকে ১০ই ডিসেম্বর অন্যান্য ভাইরা মগবাজারের বাসায় এসে পৌঁছেছে। তাদেরকে দেখতে এসেছে ভগ্নিপতি ইউসুফ। রাতে বাসা রেইড হলো। বাবা-মায়ের অনুরোধে ওরা ফায়ার এক্সচেঞ্জ করা থেকে বিরত থাকলো এবং আত্মসমর্পণ করলো খান সেনাদের কাছে। গাড়িতে ওদের তোলার সময় সর্বকনিষ্ঠ ভাইটিকে (৭/৮ বছর যার বয়স) মাত্র ওরা ক্ষমা করে ছেড়ে দিলো। কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো ওদের কেউ জানে না, কোথায় ওদের কবর তাও কেউ জানে না। বহু লাশ ঘেটে দেখেছি, ওদের চিহ্ন খুঁজে পাইনি কোথাও। পারিনি আমার সহোদরদের লাশ সনাক্ত করতে। দুঃখ এই যে ওরা আমৃত্যু লড়াই করেও প্রাণে বেঁচেছিল। কিন্তু বিজয়ের সূর্য ওঠার পূর্বক্ষণে ওরা হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছে।“

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top